Sunday 9 August 2015

আস্তাকুঁড়ের পুজো

        
টুম্পার মন ভালো নেই কয়েকদিন ধরে। এই শুরু হল। এখন চলবে বেশ কয়েক দিন, তা অন্তত মাস দুয়েক ,কম করে। প্রতি বছর এই সময়টায় ওর এরকম হয়ে থাকে। যখন কলপাড়ের পাশের ভাঙ্গা নারকোলের মালাটায় জমতে থাকা সোঁদা সোঁদা গন্ধগুলো মিলিয়ে যায় আস্তে আস্তে, ভাঙ্গা কাঠের আলনা থেকে ভেজা ভেজা ভাবগুলো হাওয়ায় হারিয়ে যায়,টুম্পার ভেতরেও কুঁকড়ে যাওয়া একটা স্বভাব জট পাকানো শুরু করে।যেমন আগের বার সেই যেদিন ঘরভাঙা বৃষ্টিটার পরে বাইরের চানঘরের লাগোয়া সিঁড়িটার ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলাগুলোর গা ঘেঁষে রোদ্দুরটা উঠলো ঝকমকিয়ে, টুম্পার হাতেপায়ে তখনও গতরাতের আলসেমিটা খেলা করে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ মায়ের স্বস্তি “ আহা কেমন রোদখানা উঠেছে দেখো ,এইবার মনে হচ্ছে আশ্বিন মাস”। শুনে এক পশলা খুব কেঁদে নিয়েছিলো সে। বর্শা যে তার খুব আপনার কেউ, সেরকম না। বরং ঝামেলার,বিপদেরও।এক একটা সময় যখন উথালপাতাল আকাশ ভেঙ্গেচুরে আছড়ে পড়ে মাটিতে , দরমার বেড়ার আগলগুলো একের পর এক ঝাপটার আড়ালে অসহায় মুখ লুকোয় কান্নায়।মাথার ওপরে চালচুলোদের ফাঁকফোঁকর,খাটের পাশের জানলার মরচে ধরা গরাদ, ক্ষয়ে যাওয়া দেওয়ালগুলোর প্রতিরোধ গড়ার মরিয়া চেষ্টাটা পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়।বেশিরভাগ সময়েই হেরে যায়,ক্ষতবিক্ষত কাঠামোয় মুখ ঢাকে। তবুও প্রতিবার তার মনে হয় মেঘগুলো কালো আর ভারি হয়েই থাকুক, হালকা তুলোর মতো উড়ে বেড়াবার দরকার নেই। যেন ওরাই মা-বাবাকে নিয়ে পাড়ি দেবে দূরপাল্লায়। দুলী মাসি এসে থাকে বটে, তবে তার হাতে রাঁধা পুঁইমিটুলিতে মা-মা স্বাদটা আর কই?।সবাই বলে বছরের এই সময়টুকুতেই নাকি ধুলো-ময়লাগুলো গায়ে একটু কম লাগে। রোজের শাক-পাতা-ছাইপাশগুলোও স্বাদ বদলে কেমন যেন কোরমা-কালিয়া মনে হয়। তবু টুম্পার ভালো লাগে না। আকাশজুড়ে তুলোর মতো মেঘগুলো যখন ছোঁয়াছুয়ি কানামাছি খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়ে, মাঝেমাঝে আবার খিলখিলিয়ে উঁকি মারে, টুম্পা কেমন আনমনা চুপসে যায়।মা খাটের তলা থেকে টেনে বের করে সেই ব্যাগটা, লাল কমলা নাকি কালো? বয়সের আড়ালে রঙটা চেনা যায়না ঠিক। এদিক-সেদিক সেফটিপিন ফুঁড়ে অভাব অনটন দুঃখ কষ্টগুলো বেরিয়ে আসে স্পষ্ট হয়ে।টুম্পা জানে ওটাতে কি আছে। কানা-উচু হাতা শুক্তোর জন্য,চ্যাপ্টা খুন্তিটা কষা মাংসের, পাতার মতো চামচে জুড়ে শুধুই চাটনি।মায়ের এইসব লুকোনো অস্ত্রের ঠুংঠাং ঠোকাঠুকিতে সব্জি-আনাজ-মশলাপাতি বদলে যায় তৃপ্তিতে। তার কপালে খুব একটা জোটে না এসব।মায়ের মুখেই জানতে পারে “ ওই আগমনী কেওলাবের বৌদিরা বলছিল কি দারুন হাত গো তোমার, থোরের ঘণ্ট তারপর পাবদা মাছটা ...”। আফসোস হয় বটে, তবে কষ্ট হয় না। মায়ের চোখে-মুখে টক-ঝাল আনন্দটাই পেট ভরিয়ে দেয়। হঠাৎ একটা আওয়াজে হারিয়ে যাওয়া মনটা আবার ফিরে আসে বর্তমানে, দেখে বাবা সরু মোটা কাঠিগুলোকে ঝাড়পোঁচ করে গুছিয়ে নিচ্ছে গুনেগুনে ,ঢাকের গায়ে চকমকি কাচ বসান জামা পরিয়ে দিচ্ছে। বাবার হাতের বেঁটেলম্বা কাঠিগুলোকে , মায়ের ওই ব্যাগটাকে এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না সে। যেন ওরাই আসামী ,টেনে হিঁচড়ে বাবা মাকে নাগালের বাইরে শহরের ভিড়ভাট্টায় নিয়ে যায় ।কত্তবার রাতের বেলা দু-চোখের পাতায় ওই ব্যাগটাকে ধোপা-পুকুরে ডুবিয়ে এসেছে,ড্যাম কুরকুর শব্দগুলোর গলা টিপে ধরেছে। তারপর ভোর হয়ে যায় আচমকা, জানলার ফাঁক দিয়ে কড়া রোদ্দুরটা এসে থামিয়ে দেয় স্বপ্ন। দেখে বাবা ভ্যানরিকশায় জড় করছে রুটিরুজির জোগাড় একটা-দুটো ,বাদবাকি বছরটায় স্বচ্ছ্বল থাকার ভীষণরকম আরাম কয়েক শিশি, ধার-দেনার অঙ্কগুলো আরও কিছুটা কম করার চেষ্টা ছিঁটেফোঁটা। দেখতে দেখতে ছোট্ট মনটাও ওই মেঘগুলোর মতো কালো আর ভারী হয়ে ওঠে ।মা এসে জড়িয়ে ধরে দু-হাতে। গাল ভেজা মিষ্টি চুমুটা কেমন নোনতা হয়ে হারিয়ে যায় মা-মেয়ের চোখে ।ছোটো মুঠোটায় দশ-কুড়ির দু-তিনটে নোট ।“লক্ষী হয়ে থাকিস মা, ইচ্ছে হলে কিছু কিনে খাস। গলা বুজে আসে গরীবিয়ানায়। ভ্যানরিকশা ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায়। পুজোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে ঘরে-বাইরে, পাড়ায় পাড়ায় সংঘে ক্লাবে ঢাক বেজে চলে সার্বজনীন, অষ্টমীর অঞ্জলিতে, নবমীর বোধনে। দুপুরে রাতে শালপাতায়ে, কাগজের থালায় হইহুল্লোড় গড়াগড়ি খায়।দ্বন্দ্ব ,দূরত্ব হারিয়ে যায় আলো ঝলমলে রাস্তায়, স্বজন-অভিজন-ঘর-পরিবার হাত ধরাধরি করে ভিড় করে উৎসবে। শুধু মণ্ডপের উল্টোদিকে বেশ খানিকটা অন্ধকারে এঁটো-কাঁটার পাশে দাঁড়িয়ে পুড়তে থাকে চালচুলোহীন জীবন, আস্তাকুঁড়ের জীবন, উদ্বাস্তুর জীবন।


No comments:

Post a Comment