“কি রে ময়লা ?হাঁ করে কি ভাবছিস?এখনো কেউ
আসেনি বুঝি?
রহিম চাচার হাঁকডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়
ছেলেটা।পাশে রাখা বেরং প্লাস্টিকটার দিকে করুণ মুখে তাকায়।ইশশশ... আজ বোধহয় আরমাস্টারমশাই এর কাছে
যাওয়া হল না। আজ আকাশের তারা, সূর্য, ছায়াপথ আরও কত কি রূপকথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি
করবেন তিনি।কিছুই জানা হবে
না।সারাদিনের ক্লান্তি,
আধপেটা খিদে, নুন-পান্তা নিয়ে প্রতিদিনের অনিশ্চয়তা,গায়ে লেগে থাকা অভাবের শ্যাওলা ...সব কিছুর মধ্যে ওই একটা জিনিসই তার
সবচেয়ে ভাল লাগে। আকাশ...।কত বড় ... শুরু শেষ মাপা যায় না।দিনের বেলা আমরা যে সূর্যকে দেখতে পাই, তার
মধ্যে নানা ধরনের কণা কতরকমের বিক্রিয়া হতে থাকে সবসময়।আর রাতেরবেলা কত নাম-না-জানা আলো কখনও স্থির
হয়ে, কখনো মিটমিট করে কতরকমের ছবি
আঁকেআকাশে। তার জানতে
ইচ্ছে করে সবকিছু, ছুঁতে ইচ্ছে করে ওদেরকে।
মাস্টারমশাই হেসে বলেন ...”তুই বড় হয়ে
মহাকাশচারী হবি ,বুঝলি? মহাকাশচারীকে ইংরেজিতে কি বলে জানিস ? অ্যাস্ট্রনট”।
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। এও কি সম্ভব?
বাবা বলে... “ ভালো করে টেন কেলাসটা পাস দে,
তারপর তোকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দেব।“
আর মাত্র চার বছর?ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলের করগুলোর
মনখারাপ হয়ে যায়।
মা অবশ্য অন্য কথা বলে, “কেন গো ? আহা
ছেলেটা আমার কত্ত পাস দেবে, তুমি যে কি বল না, ও আমাদের কপাল, ওর পয়ে এখন দোকানটা
তাও চলে মোটামুটি, ভুলে গেলে সেইসব অভাবের দিনগুলো?”
পয় –এই আর একটা বিরক্তিকর শব্দ, যার জন্য
তাকে প্রতিদিন ভোরবেলা দোকান খুলে হাঁ করে বসে থাকতে হয়, কখন সেই প্রথম লোকটা আসবে
তার ছুটির খবর নিয়ে। এক এক দিন মনে হয় দোকানের চাবির গোছাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
পালিয়ে যেতে। কিন্তু মার মুখটা ভেসে এসে সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। মনে পড়ে যায় মার
মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া...” বাবা, তুই আমাদের লক্ষ্যি
ছেলে, তোর হাতে বউনিটা হলে সারাদিনটা ভাল যায়, মানিক আমার , এইটুকু করে দে মায়ের
মুখ চেয়ে... “
তাই এই ঠায় বসে থাকা... লাল, নীল বিস্কুটের প্যাকেট, চিনি-নুনের বয়াম, সাবন, তেলের নতুন প্যাকেট,
তেলচিটে গন্ধ,সব্বাই যেন দাঁত বার করে হাসতে
থাকে তার বন্দি-দশা দেখে।তবে কেউ না কেউ
ঠিক জুটে যায়।কোনোমতে খদ্দেরকে
মালটা ধরিয়ে পাশের দোকানের
রহিমচাচার জিম্মায় দোকানটা রেখেই ছুট, “বাবা...বউনি হয়ে গেছে, তুমি যাও...”। রঙচটা
প্লাস্টিকে দমবন্ধ স্বপ্নগুলো এবার এক এক করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে নিজেদের মতন। কিন্তু আজ যে কেন এত দেরি হচ্ছে
...........................
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
* * * * * * * *
আর কতক্ষণ ছুটতে হবে কে জানে?পা দুটো
নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।পেছনে কি ওরা আসছে ,ঠিক ঠাহর করতে পারছে না
বাদল।এখন আর পেছনে তাকানোও যাবে না, আপেক্ষিক গতি একটুও কমলেই চিরকালের মত জড় হয়ে
যেতে হবে। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো ... আজ পর্যন্ত এরকম বিপদ তার খুব একটা হয় নি।
পকেটমারি ,ছোটোখাটো ছিনতাই তার কাছে জলভাত।তবে রমেনদা বলেছিল বটে
“ খুব সাবধান বাদল, পকেট চুরি আর মানুষের
প্রাণ চুরি কিন্তু এক জিনিস নয়। তবে বউনিটা ঠিকঠাক উতরে দিলে চাপটা কমবে। তোর ওপর
আমার ষোলোআনা ভরসা আছে,তুই পারবি।“ আজ সকাল থেকেই
কেমন একটা কু-ডাক দিচ্ছিল ভেতরটা । ইচ্ছে করছিলো না বেরোতে। বউটা যখন ডাক দিলো
সকালে, আলসেমিটা কিছুতেই পিছু ছাড়ছিলো না, গরম উনুনের
আঁচে দারিদ্রতা ভীষণ স্পষ্ট হলেও নতুনের রেশটা এখন মিলিয়ে যায়নি বউটার মুখ থেকে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো সব খারাপ ছেড়ে নিখাদ ভালো হওয়া যায় না? যায়
না... আর যায় না বলেই সেদিন রমেশদার কাছে ছুট্টে গেছিলো সে, দুটো পেটে আধপেটা গ্রাস
সয় না। “সবই তো বুঝলাম, তবে ইলেকশনের জন্য কিন্তু হেব্বি ক্যাচাল চলছে সব জায়গায়,
খুব বুঝে-সুঝে কাজ করতে হবে, শোন মালটাকে খতম করেই পালাবি, তিন-চার দিন একদম
সন্টু-মনা হয়ে বউয়ের আঁচলে, আমি ঠিক ডেকে বখরা দেব।“ সব কিছু ঠিকই ছিলও, শুধু গুলি
চালাবার সময় হাতটা কেমন করে কেঁপে গেল, বউনি তো, ব্যাসস, আর কি, মালটা সাঙ্গোপাঙ্গ
নিয়ে ধাওয়া করেছে। তবে এবারে একটু বসতেই হবে, নাহলে এমনিই দমটা বেরিয়ে যাবে।ওই যে
একটা বাড়ি মত দেখা যাচ্ছে। বাদল শেষবারের মত শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছুটতে
থাকে। কাছে আসতে আসতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের ভ্রম, বাড়ি না দোকান। তাও চলবে।পেছন
ফিরে তাকায়,না, ওরা আসছে না। যাক একটু নিশ্চিন্ত। হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানের সামনে
রাখা বেঞ্চটায় বসে, কোমরের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রটা নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে
ভালভাবে।
“কি চাই দাদা, একটু
তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়, আমাকে পড়তে যেতে হবে “।
“একটু জল দে তো “
ধুর বাবা, যাও বা একটা লোক এল, তার শুধু জল
চাই, বোতল নিয়ে এগিয়ে যায় ছেলেটা। লোকটা কেমন যেন, স্বাভাবিক নয়, ভালোও নয়। আবার
বন্দুকও আছে সাথে। দোকানের সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় সে, আর কিছু চাইবে না লোকটা
?কিচ্ছু না?
“অ্যাই ছেলে তোর দোকানে দেশলাই বাক্স আছে?”
আনন্দে চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে ছেলেটার।বউনি
হয়ে গেছে,এবার তার মুক্তি।এক লাফে ঢুকে যায় দোকানে।
বাদল উঠে দাঁড়ায় , দোকানের সামনের রাস্তায়।
“দু টাকা “...
মুখের বিড়িটা ধরিয়ে সুখটান দিতে শুরু করে বাদল।
ছেলেটা মনে মনে আরও অস্থির হয়ে পড়ে, “ইয়ে
টাকাটা ...।“
পকেট থেকে টাকাটা বের করে ছেলেটার হাতে দিতেই
পেছন থেকে একটা কর্কশ চিৎকার ... “ ওরে শুয়োরের বাচ্চা, এখানে বিড়ি ফোঁকা হচ্ছে?”
ছেলেটার দুপাশ দিয়ে দুটো রিভলবার বেরিয়ে পড়ে।
হঠাৎ কান ফাটানো গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। বাদলের আঙ্গুলগুলো বউনি করে
শেষপর্যন্ত, ছোট্ট শরীর জুড়ে গনগনে সূর্যবিক্রিয়া করতে থাকে,লোহিত-শ্বেতকণিকাগুলো একটু একটু করেমিলিয়ে যায় আকাশে।
বাপরে, প্লটটা দারুণ তো। দুটো আলাদা ধারার জীবন মিলল এমন একটা জায়গায়, অদ্ভুত সুন্দর। বেশ লাগল পড়তে।
ReplyDelete