Friday, 14 August 2015

বউনি

“কি রে ময়লা ?হাঁ করে কি ভাবছিস?এখনো কেউ আসেনি বুঝি?
রহিম চাচার হাঁকডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় ছেলেটা।পাশে রাখা বেরং প্লাস্টিকটার দিকে করুণ মুখে তাকায়।ইশশশ... আজ বোধহয় আরমাস্টারমশাই এর কাছে যাওয়া হল না। আজ আকাশের তারা, সূর্য, ছায়াপথ আরও কত কি রূপকথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন তিনি।কিছুই জানা হবে না।সারাদিনের ক্লান্তি, আধপেটা খিদে, নুন-পান্তা নিয়ে প্রতিদিনের অনিশ্চয়তা,গায়ে লেগে থাকা অভাবের শ্যাওলা ...সব কিছুর মধ্যে ওই একটা জিনিসই তার সবচেয়ে ভাল লাগে। আকাশ...।কত বড় ... শুরু শেষ মাপা যায় না।দিনের বেলা আমরা যে সূর্যকে দেখতে পাই, তার মধ্যে নানা ধরনের কণা কতরকমের বিক্রিয়া হতে থাকে সবসময়।আর রাতেরবেলা কত নাম-না-জানা আলো কখনও স্থির হয়ে, কখনো মিটমিট করে কতরকমের ছবি আঁকেআকাশে। তার জানতে ইচ্ছে করে সবকিছু, ছুঁতে ইচ্ছে করে ওদেরকে।
মাস্টারমশাই হেসে বলেন ...”তুই বড় হয়ে মহাকাশচারী হবি ,বুঝলি? মহাকাশচারীকে ইংরেজিতে কি বলে জানিস ? অ্যাস্ট্রনট”।

এই চিঠি সেইসমস্ত মেয়েদের চিঠি যাদের মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক ছিলোনা, যথাযথ ছিলোনা, প্রাপ্য ছিলোনা

মা তুমি কেমন আছ?
আমি বেশ আছি,
মরে গিয়ে বেঁচেছি,
মেয়েমানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সব শাস্তিগুলো এক্কেবারে মিলিয়ে গেছে মৃত্যুর পরে|

Sunday, 9 August 2015

মা


এখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আচমকা
ভেজা বালিশ চোখ মুছিয়ে দেয়
জানলার ফাঁকে এক চিলতে আকাশ তারাদের নিয়ে তোমার মুখ আঁকে

মা তোমার মনে আছে ,

মরণের পরে

“কি গো? এতো দেরি হল?আমি সেই কখন থেকে বসে আছি”
“হ্যাঁ, ট্রেনটা মিস করেছিলাম।“
“ওমা, সুটকেসটাকি ওরা দিলো, কি সুন্দর গো”
নির্মলা বলেই চলে, বটকৃষ্ণ কিরকম হারিয়ে আছে।
“খেতে দাও, খিদে পাচ্ছে।“

ট্রিং ট্রিং, অ্যালার্মটা বেজেই চলেছে। “কি গো, আজ আবার অ্যালার্ম বাজছে কেন? তোমার কি মাথাটা গেলো নাকি? বন্ধ কর ওটাকে...” সত্যিই তো, ঘুমভাঙ্গা যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসে বটকৃষ্ণহঠাৎ করে মনে হয়মানুষ বোধহয় সবচেয়ে বেশি অভ্যেসেই বশ হয়জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ঝুড়ি মাথায় সব্জিওয়ালা , ক্যান হাতে দুধওয়ালা সবার দিন জুড়ে গতকাল সকালটা ঠিক একই ভাবে আড়মোড়া ভাঙছে আজকেও , শুধু তার বর্তমানটাই কেমন যেন তালকাটা, খানিকটা আলসে হয়ে ফুরিয়ে গেছে। তার শরীর জুড়ে দৌড়ঝাঁপ নেই, ঘামে চপচপে গন্ধ নেই, ছাটাইয়ের অনিঃশ্চয়তা নেই, ভিড়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে যাওয়া নেই। মাথার পাশে রাখা বোতলটা থেকে গলা ভিজিয়ে নেয় খানিক। তারপর শুয়ে পড়ে আবার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুড়ো সাইকেলটার পায়ে পায়ে স্টেশন যাবার এবড়োখেবড়ো রাস্তা, গা ঘেঁষাঘেঁষি কল্যানী লোকাল ,অফিস পাড়ার রুতি-ঘুগনি, চোখ বুজে আসে তার।

দুপয়সার রবি

                    
আমরা যারা রবি ঠাকুর বলি, শুনি, পড়ি বা গাই- আমাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আলাপ হয় মা-বাবা, শিক্ষক কিম্বা নিছক পড়ার বইয়ের হাত ধরে। কেউ উপহার পেয়েছি, কেউ বাড়িতে পরম্পরায়, কেউ শখে ,কেউ বা লাইব্রেরীতে। যে মেয়েটার কথা এখন বলব, তার সাথে রবির আলাপ কিছুটা অন্যরকম, কিছুটা ব্যতিক্রম।

সকাল থেকে সময় যেন কাটছে না লক্ষ্মীর, যদিও সপ্তাহের ছটা দিন জুড়ে শুধু এই একটা দিনই খেলা করে তার মাথার মধ্যে । আজ যে ছুটি, নিয়মিত প্রতিদিনের ছুটি। বাসী রুটি খেয়ে না খেয়ে রোদ্দুর পায়ে হেঁটে যাওয়া সেই পথটার ছুটি। আজ সব্বার ছুটি, শুধু মাকে ছাড়া। মন থেকে না হলেও মার এই যাওয়াটাকে চুপচাপ মেনে নেয় লক্ষী, প্রতিবার,মা ফিরলে একটু ভালো খাওয়া জুটবে এইভেবেরোজকার পোড়া রুটি, আলুনী তরকারিরা রোববার কিরকম যেন বদলে যায় লুচি-পরোটায়। হারিয়েই গেছিলো মনটা।“কি রে? কখন থেকে ডাকছি...” লক্ষীর চোখ প্রথমেই চলে যায় মার ঝুলিতেআজ যেন প্রয়োজনের থেকে একটু বেশীই বড় সেটা। তাহলে কি বিশেষ কিছু? অনেক পরিমাণে? “দ্যাখ তো এগুলো, বাবুদের বাড়ি থেকে দিলে, বললে পুরনো হয়ে গেছে, পোকা ধরে গেছে, আমি ভাবলাম নিয়ে আসি, বেচলে যদি কিছু আসে...” সেফটিপিনে গোঁজাতালি মারাসঞ্চয়-পুঁটলি থেকে একে একে বেরোতে থাকে বাঁধাই করা শব্দ বাক্য ঝাঁকপড়ে পাওয়া ছুটির দুপুরে ছদিনের একটু একটু জমা খিদেরা কি আর শান্তি পায় এতে?ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটাবিরক্তি নিয়ে ভাঙ্গাচোরা চারপেয়ে জুড়ে একে একে সাজানো শুরু করে মোটা মোটা বইগুলোকেছবিটা চেনা, নামটাও শুনেছে স্কুলে বারকয়েক। খানিকটা কৌতূহল নিয়েই ওল্টাতে থাকেপাতাসময়ের ওজোন কালো অক্ষরগুলোয় কেমন পাক ধরিয়েছে, ভাঁজ ফেলেছে, বই-পোকাদের ঘরবাড়ি ছোটবড় নানা রকমের এদিক সেদিকে। হঠাৎই চোখ আটকে গেল কয়েকটা লাইনে, একি এসব কি লেখা?

আস্তাকুঁড়ের পুজো

        
টুম্পার মন ভালো নেই কয়েকদিন ধরে। এই শুরু হল। এখন চলবে বেশ কয়েক দিন, তা অন্তত মাস দুয়েক ,কম করে। প্রতি বছর এই সময়টায় ওর এরকম হয়ে থাকে। যখন কলপাড়ের পাশের ভাঙ্গা নারকোলের মালাটায় জমতে থাকা সোঁদা সোঁদা গন্ধগুলো মিলিয়ে যায় আস্তে আস্তে, ভাঙ্গা কাঠের আলনা থেকে ভেজা ভেজা ভাবগুলো হাওয়ায় হারিয়ে যায়,টুম্পার ভেতরেও কুঁকড়ে যাওয়া একটা স্বভাব জট পাকানো শুরু করে।যেমন আগের বার সেই যেদিন ঘরভাঙা বৃষ্টিটার পরে বাইরের চানঘরের লাগোয়া সিঁড়িটার ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলাগুলোর গা ঘেঁষে রোদ্দুরটা উঠলো ঝকমকিয়ে, টুম্পার হাতেপায়ে তখনও গতরাতের আলসেমিটা খেলা করে বেড়াচ্ছে।

ফেব্রুয়ারি একুশ আর একটি অভাবিত মৃত্যু

       
একটা রক্তমাখা মৃত্যু পড়ে আছে রাজপথে
বাকি শবস্তূপ থেকে কিছুটা দূরে, আলাদা
এদিক-ওদিক পুলিশ-পরিজন-পথচারীর ভিড়
শনাক্তকরণ চলছে, শুধু ওকে ঘিরেই কেমন গুমোট শূন্যতা,
যেন ওর কেউ নেই ,অথবা এখানে ওর উপস্থিতিটা ঠিক প্রত্যাশিত ছিলনা ।

চুনকাম খসা ঘরটায় হ্যারিকেন জ্বলছিল একটা,
চাপা উদ্বেগ, হাতের চুরির ঝনঝন আর শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা পেরিয়ে
ছেলেটা যখন জন্মালো, তখনও সে জানে না
এক, দুই, তিন... বছর পেরিয়ে গেলেও শব্দ আসবে না,
তখনও সে জানে না -যতক্ষণ না ছাদের সিঁড়ি বেয়ে হলুদ আঁচলের গন্ধ ভেসে আসে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত
সে একতলার শোবার ঘরে শুয়ে মা বলে চিৎকার করতে পারবে না কোনোদিন
শুরু শুরুতে চেষ্টা ছিল বেদম, গলার শিরা ফুলে যেত, নিঃশ্বাস আটকে যেত
ধীরে ধীরে মেনে আর মানিয়ে নেওয়াটাই পড়ে থাকলো
আর থাকলো অভিমান, হিংসা, রাগ...
হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো স্বর আর ব্যাঞ্জনগুলোকে বোবা কৌটোয় বন্দী করার ব্যর্থ ইচ্ছে।

ফুল, পাখি, চাঁদ, তারাদের সাথে শব্দহীনদৈনন্দিন ভাগ করে নিয়ে চলছিল কোনোমতে
কিন্তু বেশ কিছুদিনধরে ছেলেটা টের পেল, বর্তমান বাঁধছে অন্য এক অস্থিরজোট
দেশ চালানোর নামে চলছে বীভৎস নৃশংস খেলা
ক্ষমতায় থাকা উদ্ধত আঙ্গুলগুলো অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরছে ল্যারিংস, এপিগ্লটিস,
মায়ের কোলে রোদ পোহানো,বড় হওয়া অক্ষরগুলো পিষে যাচ্ছে শোষণে, মিশে যাচ্ছে মাটিতে
দুপুরের রোয়াকে, বিকেলের কলেজ ক্যান্টিনে, রাত্রের গরম ভাতে,
রেডিও, খবরের কাগজে, দেওয়ালে দেওয়ালে মগজে জন্ম নিচ্ছে আগুন
আইনি দোহাই দিয়ে টুঁটি চেপে ধরার বে-আইনি অভ্যেসে বিরোধ আসতে শুরু করছেধীরে ধীরে
ছেলেটা নজর করছিল সবই, তবু ঠিক নিজের করে উঠতে পারছিল না
সেদিন রাতের টেবিলে দাদা বলে উঠলো
“কাল একটা এসপারওসপার হোক, এভাবে আর চলতে পারে না”
কাকুমনি বরং কিছুটা হিসেবী
“দেখ, আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগোতে হবে, আবেগের একটা ভুলে
ভবিষ্যৎ পিছিয়ে যেতে পারে অন্ধকারে, অনেকটা”
মার গলায় কেমন যেন অশুভ উদ্বেগ “বাবু, খুব সাবধানে, আমার কথা একটু ভাবিস, তোর কিছু হয়ে গেলে...”
ছেলেটা জলের গেলাসে হাত বাড়ায়, সর্ষে-বেগুনে ঝালটা আজ একটু বেশি
দাদা উত্তেজিত “ও তো রইল, ও তো আর এসবেরমধ্যে নেই, তোমার বাধ্য চুপচাপ ছেলে
তা বলে আমাদেরও বোবা করে দেবে ওর মতো, আর আমরা মুখ বুজে মেনে নেবো?”
হাত ভর্তি জল থতমতকেঁপে যায়, পড়ে যায়, ভিজে যায় লজ্জায়
টেবিল ছেড়ে ঘরে ফিরে আসে ছেলেটা, আনমনা
বোবা হয়ে যাবে সবাই? এক্কেবারে তার মতো?
ছোট থেকে বড় হওয়া সরল, জটিল বাক্যগুলো দমবন্ধ পচতে থাকবে চার দেওয়ালে ?ঠিক তার মতো?
ঠিক তার মতো কোনো প্রেমিক বেখেয়ালি কবি হয়ে এক-বাজার জনতার সামনে
তার প্রেয়সীর ঠোঁটে এক চিলতে লজ্জা এনে দিতে পারবে নাকোনোদিন?
রাগে-অপমানে-ঘেন্নায়-প্রতিবাদে কোনো কলম, কোনো কণ্ঠ গর্জে উঠবে না,
নিজের জন্য, একেবারে নিজের করে বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ সাজিয়ে নিজেদের কথা আর কেউ বলতে পারবে না কখনো
ভেবে যায় ছেলেটা, দরজার ফাঁকে হাসতে থাকে দীর্ঘ বছরের অপমান, রাত-জাগা কান্নার দল।

পরদিন ফেব্রুয়ারী একুশ, সকাল ৯টা
সারি সারি কালো বিক্ষোভ জমা হয়েছে শহরের বুকে
ভাঙতে চাইছে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সমস্ত ফরমান
শরীরের প্রতিটা শিরায় শিরায় রক্ত-মাংসে বেড়ে ওঠা বর্ণমালার মিছিল
যারা কখনো ভালোবেসে গল্প বলেছে, কখনো আহতশরীরেভিজে গেছে কবিতায়
আজ - আজ শুধু প্রতিবাদ হয়ে ছিঁড়তে চাইছে আধিপত্যের এক একটাপরোয়ানা
এগিয়ে চলেছে দুঃসাহস রাজতন্ত্রের ব্যারিকেড লক্ষ্য করে
হঠাৎ গর্জে উঠল উর্দি-ধারী শাসন-বন্দুক, স্বেচ্ছাচারের বুলেটে ছিন্নভিন্ন ধ্বনি-বর্ণেরা
চারিদিকে হইচই চিৎকার ভিড় ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে
লুটিয়ে পড়ল ভাষাহীন, শব্দহীন এক টুকরো বিপ্লব
প্রথম এবং হয়তো বা শেষবারের মতো নির্বাক পৃথিবী কেঁদে উঠলো সশব্দে
বোবা হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো মায়ের আদর-জড়ানোঅক্ষরগুলো
স্বাধীনতার গন্ধ মেখেছড়িয়ে পড়লো আকাশে।