একটা রক্তমাখা
মৃত্যু পড়ে আছে রাজপথে
বাকি শবস্তূপ
থেকে কিছুটা দূরে, আলাদা
এদিক-ওদিক
পুলিশ-পরিজন-পথচারীর ভিড়
শনাক্তকরণ চলছে,
শুধু ওকে ঘিরেই কেমন গুমোট শূন্যতা,
যেন ওর কেউ নেই
,অথবা এখানে ওর উপস্থিতিটা ঠিক প্রত্যাশিত ছিলনা ।
চুনকাম খসা ঘরটায়
হ্যারিকেন জ্বলছিল একটা,
চাপা উদ্বেগ,
হাতের চুরির ঝনঝন আর শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা পেরিয়ে
ছেলেটা যখন
জন্মালো, তখনও সে জানে না
এক, দুই, তিন...
বছর পেরিয়ে গেলেও শব্দ আসবে না,
তখনও সে জানে না
-যতক্ষণ না ছাদের সিঁড়ি বেয়ে হলুদ আঁচলের গন্ধ ভেসে আসে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত
সে একতলার শোবার
ঘরে শুয়ে মা বলে চিৎকার করতে পারবে না কোনোদিন
শুরু শুরুতে
চেষ্টা ছিল বেদম, গলার শিরা ফুলে যেত, নিঃশ্বাস আটকে যেত
ধীরে ধীরে মেনে
আর মানিয়ে নেওয়াটাই পড়ে থাকলো
আর থাকলো অভিমান,
হিংসা, রাগ...
হাওয়ায় ভেসে
বেড়ানো স্বর আর ব্যাঞ্জনগুলোকে বোবা কৌটোয় বন্দী করার ব্যর্থ ইচ্ছে।
ফুল, পাখি, চাঁদ,
তারাদের সাথে শব্দহীনদৈনন্দিন ভাগ করে নিয়ে চলছিল কোনোমতে
কিন্তু বেশ
কিছুদিনধরে ছেলেটা টের পেল, বর্তমান বাঁধছে অন্য এক অস্থিরজোট
দেশ চালানোর নামে
চলছে বীভৎস নৃশংস খেলা
ক্ষমতায় থাকা
উদ্ধত আঙ্গুলগুলো অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরছে ল্যারিংস, এপিগ্লটিস,
মায়ের কোলে রোদ
পোহানো,বড় হওয়া অক্ষরগুলো পিষে যাচ্ছে শোষণে, মিশে যাচ্ছে মাটিতে
দুপুরের রোয়াকে,
বিকেলের কলেজ ক্যান্টিনে, রাত্রের গরম ভাতে,
রেডিও, খবরের
কাগজে, দেওয়ালে দেওয়ালে মগজে জন্ম নিচ্ছে আগুন
আইনি দোহাই দিয়ে
টুঁটি চেপে ধরার বে-আইনি অভ্যেসে বিরোধ আসতে শুরু করছেধীরে ধীরে
ছেলেটা নজর করছিল
সবই, তবু ঠিক নিজের করে উঠতে পারছিল না
সেদিন রাতের
টেবিলে দাদা বলে উঠলো
“কাল একটা
এসপারওসপার হোক, এভাবে আর চলতে পারে না”
কাকুমনি বরং
কিছুটা হিসেবী
“দেখ, আমাদের
মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগোতে হবে, আবেগের একটা ভুলে
ভবিষ্যৎ পিছিয়ে
যেতে পারে অন্ধকারে, অনেকটা”
মার গলায় কেমন
যেন অশুভ উদ্বেগ “বাবু, খুব সাবধানে, আমার কথা একটু ভাবিস, তোর কিছু হয়ে গেলে...”
ছেলেটা জলের
গেলাসে হাত বাড়ায়, সর্ষে-বেগুনে ঝালটা আজ একটু বেশি
দাদা উত্তেজিত “ও
তো রইল, ও তো আর এসবেরমধ্যে নেই, তোমার বাধ্য চুপচাপ ছেলে
তা বলে আমাদেরও
বোবা করে দেবে ওর মতো, আর আমরা মুখ বুজে মেনে নেবো?”
হাত ভর্তি জল থতমতকেঁপে
যায়, পড়ে যায়, ভিজে যায় লজ্জায়
টেবিল ছেড়ে ঘরে
ফিরে আসে ছেলেটা, আনমনা
বোবা হয়ে যাবে
সবাই? এক্কেবারে তার মতো?
ছোট থেকে বড় হওয়া
সরল, জটিল বাক্যগুলো দমবন্ধ পচতে থাকবে চার দেওয়ালে ?ঠিক তার মতো?
ঠিক তার মতো কোনো
প্রেমিক বেখেয়ালি কবি হয়ে এক-বাজার জনতার সামনে
তার প্রেয়সীর
ঠোঁটে এক চিলতে লজ্জা এনে দিতে পারবে নাকোনোদিন?
রাগে-অপমানে-ঘেন্নায়-প্রতিবাদে
কোনো কলম, কোনো কণ্ঠ গর্জে উঠবে না,
নিজের জন্য,
একেবারে নিজের করে বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ সাজিয়ে নিজেদের কথা আর কেউ বলতে পারবে
না কখনো
ভেবে যায় ছেলেটা,
দরজার ফাঁকে হাসতে থাকে দীর্ঘ বছরের অপমান, রাত-জাগা কান্নার দল।
পরদিন ফেব্রুয়ারী
একুশ, সকাল ৯টা
সারি সারি কালো
বিক্ষোভ জমা হয়েছে শহরের বুকে
ভাঙতে চাইছে জোর
করে চাপিয়ে দেওয়া সমস্ত ফরমান
শরীরের প্রতিটা
শিরায় শিরায় রক্ত-মাংসে বেড়ে ওঠা বর্ণমালার মিছিল
যারা কখনো
ভালোবেসে গল্প বলেছে, কখনো আহতশরীরেভিজে গেছে কবিতায়
আজ - আজ শুধু প্রতিবাদ
হয়ে ছিঁড়তে চাইছে আধিপত্যের এক একটাপরোয়ানা
এগিয়ে চলেছে
দুঃসাহস রাজতন্ত্রের ব্যারিকেড লক্ষ্য করে
হঠাৎ গর্জে উঠল
উর্দি-ধারী শাসন-বন্দুক, স্বেচ্ছাচারের বুলেটে ছিন্নভিন্ন ধ্বনি-বর্ণেরা
চারিদিকে হইচই
চিৎকার ভিড় ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে
লুটিয়ে পড়ল ভাষাহীন,
শব্দহীন এক টুকরো বিপ্লব
প্রথম এবং হয়তো
বা শেষবারের মতো নির্বাক পৃথিবী কেঁদে উঠলো সশব্দে
বোবা হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
বেরিয়ে এলো মায়ের আদর-জড়ানোঅক্ষরগুলো
স্বাধীনতার গন্ধ
মেখেছড়িয়ে পড়লো আকাশে।